বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে করণীয় কী?

বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে করণীয় কী?

বাংলাদেশের অন্যতম সামাজিক সমস্যা হচ্ছে বাল্যবিবাহ। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে দেশে আইন হয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে নেওয়া হয়েছে নানা পদক্ষেপ। বাল্যবিবাহের কুফল সম্পর্কে জানাতে প্রতিনিয়ত সভা-সমাবেশ আর মানববন্ধন কর্মসূচি পরিচালিত হচ্ছে। কিন্তু তাতে বাল্যবিবাহ থেমে থাকছে না। প্রত্যন্ত গ্রাম আর শহরের বস্তিগুলোতে তো বটেই, তথাকথিত শিক্ষিত আর সচেতন সমাজেও ঘটছে বাল্যবিবাহের ঘটনা। সম্প্রতি কমনওয়েলথ নারী ফোরামে প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন, বাংলাদেশে ১৮ বছর বয়সের কম মেয়েদের বিয়ের হার ২০১৫ সালের ৬২ শতাংশ থেকে কমে ২০১৭ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ৪৭ শতাংশে। এটা নিঃসন্দেহে একটি ভালো খবর। কিন্তু এই ৪৭ শতাংশও তো কম নয়। আগের চেয়ে অনেক বেশি জানেন। তাই এখন বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্য প্রচার-প্রচারণা চালানোর চেয়ে বেশি প্রয়োজন সমস্যার মূলে হাত দেওয়া। আমাদের সমাজে। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে সচেতনতা সৃষ্টিতে সরকারি ও বেসরকারিভাবে যে প্রচার-প্রচারণাগুলো চালানো হয়, সেখানে মূলত তিনটি বিষয়কে প্রাধান্য দেওয়া হয়: ১. মেয়েটির অনিরাপদ মাতৃত্ব ও স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি ২. মেয়েটির অনিশ্চিত শিক্ষাজীবন এবং ৩. নারীর বিঘ্নিত অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতায়ন। বিগত দুই দশকে উন্নয়নের বেশ কিছু সূচকে বাংলাদেশের অগ্রগতি চোখে পড়ার মতো। বাংলাদেশে বেড়েছে শিক্ষার হার আর সেই সঙ্গে বেড়েছে সচেতন জনগোষ্ঠীর সংখ্যা। তাই নিশ্চিতভাবেই এ কথা বলা যায় যে বাল্যবিবাহের ক্ষতিকর দিকগুলো সম্পর্কে এখনকার মানুষ মাতৃত্বের অনুভূতি থেকে এ কথা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলতে পারি, সামান্য বিবেচনাবোধ আছে এমন বাবা-মা জেনে-বুঝে সন্তানকে বিপদের মুখে ঠেলে দিতে পারেন না। তাই কেন বাবা-মায়েরা সন্তানকে বাল্যবিবাহের মতো একটি অভিশাপের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন, তা তলিয়ে দেখা প্রয়োজন। যে দেশে প্রায় ৮০ শতাংশ নারীই বিবাহিত জীবনে পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হন, সেই দেশের পিতা-মাতার কাছে তাঁর কন্যাশিশুর নিশ্চিত ভবিষ্যৎ হিসেবে বাল্যবিবাহ কোনো আকর্ষণীয় সমাধান হিসেবে মেনে নেওয়ার কথা নয়। নিরুপায় হয়েই তাঁরা এই পথ বেছে নিচ্ছেন। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, সামাজিক নিরাপত্তার অভাব ও দারিদ্র্য বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের অন্যতম বড় কারণ। এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে আরও বেশ কিছু বাস্তবতা। তাই বাল্যবিবাহকে রুখতে হলে এই সমস্যার মূলের দিকে নজর দেওয়া জরুরি। যৌতুক প্রথা আজও ব্যাপকভাবে বিরাজমান ২০১৭ সালের শেষ দিকে পপুলেশন কাউন্সিলের ‘অ্যাকসেলারেটিং অ্যাকশন টু এন্ড চাইল্ড ম্যারেজ ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় করা জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে, কম বয়সে মেয়ের বিয়ে দিলে যৌতুকও দিতে হয় কম। তাই অভিভাবকেরা মেয়েদের বাল্যবিবাহ দিতে উৎসাহিত হন। বগুড়া ও জামালপুর অঞ্চলে পরিচালিত এই জরিপে দেখা যায়, যেখানে ১৬ বছরের আগে মেয়ের বিয়ে দিলে গড়ে ৫০ হাজার টাকা যৌতুক দিতে হচ্ছে, সেখানে মেয়ের বয়স ১৬ থেকে ১৮ বছর হলে যৌতুকের টাকার পরিমাণ বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ৮০ হাজার এবং মেয়ের বয়স ১৮ থেকে ১৯ বছর হলে বাবা-মাকে দিতে হচ্ছে গড়ে এক লাখ টাকা। মেয়ের নিশ্চিত ভবিষ্যৎ হিসেবে বাল্যবিবাহ যে খুব একটা সুখকর সমাধান নয়, সেটি বাবা-মায়েরা ভালোভাবেই জানেন। তবে এর বিকল্প পথটির ঠিকানাও খুঁজে পাচ্ছেন না তাঁরা। তাই এই সামাজিক ব্যাধিকে রুখতে হলে বাল্যবিবাহ সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে বাল্যবিবাহের বিকল্প পথগুলো সম্পর্কে সবাইকে স্বচ্ছ ধারণা দিতে হবে। বাল্যবিবাহ রোধে সচেতনতা সৃষ্টির পৃথিবীর সর্ববৃহৎ নেটওয়ার্ক ‘গার্লস নট ব্রাইড’ নারীর জীবনের ইতিবাচক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে চারটি বিষয়কে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে: ১. নারীর ক্ষমতায়ন ২. নারীর প্রতি পরিবার ও সমাজের সচেতনতা ও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ৩. নারীর কর্মসংস্থান ৪. বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে কঠোর আইন ও তার প্রয়োগ। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে আমাদের প্রথম যে কাজটি করতে হবে তা হলো মেয়েদের নিরাপদ পথচলা নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কর্মস্থল, রাস্তাঘাট ও গণপরিবহনকে নারীবান্ধব ও যৌন হয়রানিমুক্ত করতে হবে। যৌতুক নিরোধ আইনে সাজার পরিমাণ বাড়িয়ে আইনকে যুগোপযোগী করার যে উদ্যোগ সরকার নিয়েছে, তা দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। বিভিন্ন স্তরে যোগ্যতা অনুযায়ী নারীর কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করাটা খুব জরুরি। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হতে আগ্রহী নারীদের জন্য বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। স্বল্প শিক্ষিত ও শিক্ষা ঝরে পড়া মেয়েরা যেন বেশি করে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের আওতায় আসতে পারে, সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে। এক কথায় তাদের অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা অর্জনের পথটি হতে হবে একেবারে দৃশ্যমান, যা দেখে বিয়েকেই মেয়ের জন্য একমাত্র সুরক্ষাকবচ হিসেবে বিবেচনার ধ্যানধারণা থেকে বাবা-মায়েরা বেরিয়ে আসবেন।


উপজেলা নির্বাহী অফিসার

মোঃ উজ্জল হোসেন